ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

সংঘাত বেড়েই চলছে রোহিঙ্গা শিবিরে, চরম বেকায়দায় স্থানীয়রা

শাহীন মাহমুদ রাসেল :: নিজ দেশে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে মানবিক আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা দিন দিন বেপরোয়া ও হিংস্র হয়ে উঠছে। ইয়াবা, মানব পাচার ও হাটবাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের অভ্যন্তরে একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে তাদের অপরাধ।

রোহিঙ্গাদের মারমুখী আক্রমণ থেকে রেহাই মিলছে না কারোরই। শুধু নিজ গোত্রের গণ্ডিতে এখন আর সীমাবদ্ধ নেই তাদের অপরাধ কার্যক্রম। ইতিমধ্যে তাদের রোষানলে পড়ে একাধিকবার লাঞ্ছিত হয়েছেন দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, এনজিও কর্মী, বিদেশি পরিদর্শক দলের প্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সব থেকে চরম বেকায়দায় পড়েছেন স্থানীয়রা।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (২৬ জানুয়ারি) ভোরে আধিপত্যবিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ মোজাম্মেল ওরফে শেখ ও মৌলভী ইউনুস ও নুরুল হাকিম গ্রুপের সংঘর্ষে ১ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। গত ৩ বছরে আশ্রয় শিবিরগুলোয় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে শতাধিকের মতো খুনের ঘটনা ঘটেছে। হত্যা, ধর্ষণ, মাদক পাচার, ডাকাতিসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা রোহিঙ্গারা করছে না।

স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গারা নতুন নতুন সমস্যা তৈরি করছে। জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। তাদের মারমুখী আচরণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে নিরাপত্তা শঙ্কা ও উদ্বেগ বাড়ছে। রোহিঙ্গাদের অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হচ্ছে খুনের মতো নৃশংস ঘটনা। সামান্য বিষয়ে হিংস্র হয়ে ওঠে রোহিঙ্গারা।

এদিকে উখিয়ার পালংখালীর সংবাদ কর্মী আবুল বশর বলেন, রোহিঙ্গারা দিন দিন হিংস্র হয়ে উঠছে। প্রতি মুহূর্তে তাদের রূপ বদলে যাচ্ছে। শরণার্থী শিবিরসংলগ্ন এলাকাগুলোয় স্থানীয়রা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করতে পারছে না। কোনো শাক-সবজি চাষ করতে পারছে না। চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে তারা। ক্যাম্পে এত লোক, কাকে সন্দেহ করা যায়? স্থানীয়রা এসব কারণে কোনো ক্ষতির প্রতিবাদ করতে গেলেই রোহিঙ্গারা সংঘবদ্ধ হয়ে তেড়ে আসে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী শহিদুল্লাহ বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় যেসব দেশি-বিদেশি এনজিও কাজ করছে তাদের ওপর আরও বেশি নজর রাখা উচিত। রোহিঙ্গাদের ভয়ঙ্কর কার্যকলাপে স্থানীয় লোকজন সবসময় ভয়ে ও আতঙ্কে থাকে। ফলে রোহিঙ্গারা কে কোথায় যাচ্ছে তাদের তদারকি করা দরকার।

জেলা পুলিশ ও বিভিন্ন সূত্রের তথ্যমতে, টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে রোহিঙ্গাদের ডজনাধিক অপরাধী দল রয়েছে, যারা শিবিরের অভ্যন্তরে অপরিকল্পিতভাবে দোকানপাট ও মাদক বিক্রির আখড়া তৈরি, মানবপাচার, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি ও মাদকের টাকায় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহসহ নানা অপরাধকর্ম করছে।

পুলিশসহ স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, টেকনাফ ও উখিয়ার শিবিরে সাতটি করে সন্ত্রাসী বাহিনী আছে। এর মধ্যে টেকনাফের আবদুল হাকিম বাহিনী বেশি তৎপর। এই বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য যখন-তখন লোকজনকে অপহরণ করে।

মুক্তিপণ না পেলে হত্যা করে লাশ গুম করে। ইয়াবা, মানবপাচারে যুক্ত থাকার পাশাপাশি এ বাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গা নারীদের তুলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটায়।

টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের এক জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রোহিঙ্গাদের মানবিক চিন্তা থেকে আশ্রয় দেওয়া হলেও তারা এখন আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি গত ১৯ সালের সেপ্টেম্বর টেকনাফে যুবলীগ নেতা ওমর ফারুকে রোহিঙ্গা ডাকাতরা গুলি করে হত্যা করে। পাশাপাশি নিজেদের দ্বন্দ্বের কারণে খুন, অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়েছে রোহিঙ্গারা। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে কিছু স্থানীয় চক্র। তাদের কারণে প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

তবে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন, উখিয়া-টেকনাফের সব রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধমূলক কর্মকা হচ্ছে এটা ঠিক নয়। কয়েকটি শিবিরে কিছু ঘটনা ঘটাচ্ছে কিছু অসাধু রোহিঙ্গা চক্র। তাদের জন্য সব রোহিঙ্গার দুর্নাম হচ্ছে। তাদের আইনের আওতায় আনলে সব রোহিঙ্গা দুর্নাম থেকে বেঁচে যাবে। তবে তাদের সঙ্গে কিছু স্থানীয় লোকজনের জড়িত থাকার কথা জানান তারা।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকল ইসলাম বলেন, শিবিরে লাখো রোহিঙ্গার মধ্যে কিছুসংখ্যক উচ্ছৃঙ্খল আছে। শিবিরে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো খুবই গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত ১৯ সালের ১৭ মার্চ উখিয়ার কুতুপালং গভীর রাতে রোহিঙ্গাদের হামলার শিকার হয়েছেন কুতুপালং ক্যাম্প ইনচার্জসহ পুলিশের একটি দল। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অদুরে অবস্থিত নৌকার মাঠের আধিপাত্যকে বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে ক্যাম্প ইনচার্জসহ পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছুলে রোহিঙ্গারা তাদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ ৭-৮ রাউন্ড রাবার বুলেট ছুঁড়লে রোহিঙ্গারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে ১০ রোহিঙ্গাকে আটক করে।

পাঠকের মতামত: